শুভ মহালয়া, বিশ্বের বড় ২০২৫ সালে দুর্গাপূজা

দুর্গাপূজা, বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব, যা কেবল একটি ধর্মীয় আচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সামাজিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছর শরৎকালে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা মূলত দেবী দুর্গার দশমহাবিদ্যা রূপের পূজা। 


অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির জয় এবং নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে এই উৎসব যুগে যুগে বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। ২০২৫ সালের দুর্গাপূজা আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এ বছর দেবীর আগমন ঘটছে গজে, অর্থাৎ হাতির পিঠে, যা সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসে বলে বিশ্বাস করা হয়।

পূজার সময়সূচী ও দেবীর আগমন-গমন

২০২৫ সালের দুর্গাপূজার উৎসব শুরু হচ্ছে ২১ সেপ্টেম্বর, রবিবার, মহালয়ার মাধ্যমে। এই দিনে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা হয়। এরপর মূল পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে ২৮ সেপ্টেম্বর, রবিবার, ষষ্ঠী তিথিতে, এবং শেষ হবে ২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, বিজয়া দশমীর দিনে।

  • মহালয়া: ২১ সেপ্টেম্বর, রবিবার

  • মহাষষ্ঠী: ২৮ সেপ্টেম্বর, রবিবার

  • মহাসপ্তমী: ২৯ সেপ্টেম্বর, সোমবার

  • মহাষ্টমী: ৩০ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার

  • মহানবমী: ১ অক্টোবর, বুধবার

  • বিজয়া দশমী: ২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার

জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দেবীর আগমন হচ্ছে গজে (হাতিতে), যা অত্যন্ত শুভ বলে বিবেচিত। হাতির আগমন মানেই হলো সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনা। এটি সমাজে নতুন করে এক আশার আলো নিয়ে আসে এবং ভক্তরা বিশ্বাস করে যে এটি আসন্ন বছরে মানুষের জীবনে কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। অন্যদিকে, বিজয়া দশমী বৃহস্পতিবার হওয়ায় দেবীর গমন হবে দোলায় (পালকিতে)। শাস্ত্র মতে, দোলায় দেবীর গমন অশুভ বার্তা নিয়ে আসে, যা মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইঙ্গিত দেয়। তবে ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে দেবীর আশীর্বাদে সব অশুভ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

মণ্ডপ ও প্রতিমা: ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মেলবন্ধন

২০২৫ সালের দুর্গাপূজা উপলক্ষে মণ্ডপ ও প্রতিমা তৈরিতে নতুনত্বের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যাবে। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী পাড়া এবং সর্বজনীন পূজা কমিটিগুলো তাদের থিম এবং মণ্ডপ সজ্জায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। কোনো কোনো মণ্ডপ পুরোনো দিনের ঐতিহ্যকে তুলে ধরবে, আবার কোনো কোনো মণ্ডপে আধুনিক শিল্পশৈলী ও কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগ দেখা যাবে। কুমারটুলির শিল্পীরা তাদের শৈল্পিক ছোঁয়ায় দেবী প্রতিমা তৈরি করে চলেছেন, যেখানে একই সাথে প্রাচীন রীতি এবং আধুনিক সৃজনশীলতার সমন্বয় দেখা যাবে।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য

দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সামাজিক মিলন ও সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে। এই সময়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিতজনরা একত্রিত হয়। নতুন পোশাকে সেজে ওঠা, প্যান্ডেল হপিং, বিভিন্ন ধরনের লোকনৃত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা—এই সবকিছুই দুর্গাপূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

  • সামাজিক মিলন: এই উৎসব সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একত্রিত করে। বিভিন্ন বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা কমিটিগুলো এই উৎসবকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে তোলে, যেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে।

  • অর্থনৈতিক প্রভাব: দুর্গাপূজা পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে এক বিশাল প্রভাব ফেলে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় এই উৎসবে। মণ্ডপ সজ্জা, প্রতিমা নির্মাণ, পোশাক, খাদ্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের চাহিদা এই সময় ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।

  • সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান: পূজার সময় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন—নাটক, গান, এবং নৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানগুলো স্থানীয় শিল্পীদের জন্য তাদের প্রতিভা প্রদর্শনের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে।

২০২১ সালে ইউনেস্কো কলকাতার দুর্গাপূজাকে "মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এই উৎসবের বিশ্বব্যাপী গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই স্বীকৃতি এই উৎসবের অনন্য শিল্প, রীতিনীতি, এবং সামাজিক মূল্যবোধকে তুলে ধরেছে।

উপসংহার

২০২৫ সালের দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় পূজা নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক মিলন মেলা যা বাঙালির জীবনে নতুন করে আনন্দ, মিলন এবং ভালোবাসার বার্তা নিয়ে আসবে। দেবীর আগমন যেমন শুভ বার্তা দিচ্ছে, তেমনি এই উৎসব আমাদের সবাইকে একত্রিত হয়ে যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার শক্তি যোগাবে। এটি এক এমন উৎসব যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

রান্না ও গল্পকথার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url